বিশ্ব পথশিশু দিবস আজ। সরকারি-বেসরকারিভাবে পথশিশুদের সুরক্ষায় নানা উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। রাজশাহী বিভাগে এই পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এসব শিশুর ৫১ দশমিক ১ শতাংশের বসবাস বিভিন্ন বস্তিতে। ফলে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এসব শিশু পাচ্ছে না সামাজিক সুরক্ষা। অধিকাংশই প্রতিনিয়ত নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকারও হচ্ছে। দরিদ্রতার কারণে অনেকেই কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনসহ নানা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে মাদকের নেশায়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করায় আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগে। ভুগছে পুষ্টিহীনতায়।
সম্প্রতি ইউনিসেফের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, রাজশাহী বিভাগে পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার, যা দেশের মোট পথশিশুর ১ দশমিক ৬ শতাংশ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু রাজশাহী মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডেই প্রায় দেড় হাজার পথশিশুর বসবাস। এর মধ্যে মহানগরীর বোয়ালিয়া, রাজপাড়া, কাশিয়াডাঙ্গা, মতিহার ও চন্দ্রিমা থানার অন্তর্গত ১২টি ওয়ার্ডের (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ১৭, ১৯, ২১, ২৫ ও ২৬ নং ওয়ার্ড) বিভিন্ন বস্তি এলাকায় ৬৫০ জন পথশিশু বসবাস করছে।
বেসরকারি সংস্থা কারিতাস রাজশাহী অঞ্চলের সম্প্রতি এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, মহানগরীর ১৪টি ওয়ার্ডের ২০টি বস্তি এলাকায় জরিপ পরিচালনা করে ৬ থেকে ১৮ বছরের নিচে ৭৩০ জন পথশিশুর খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৩৮৪ জন ছেলে ও ৩৪৬ জন মেয়ে পথশিশু। এসব শিশুর মধ্যে স্কুলগামী ৫৯০ জন, নিরক্ষর ৪৩ জন, সাক্ষরজ্ঞান ১১ জন এবং শিক্ষা থেকে ঝরে পড়েছে ৮৬ জন।
এসব শিশু পথশিশু হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৩৫ জন শিশুর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, ৪১ জন শিশুর বাবা/মায়ের মৃত্যু, বাবা-মায়ের অশান্তির কারণে ৫ জন, দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে ৩ জন এবং দারিদ্র্যের কারণে ৬৪৬ শিশুকে পথশিশু হতে হয়েছে।
জরিপে আরও জানা গেছে, এসব পথশিশুর মধ্যে ৬২৮ জনের বাবা-মা একসঙ্গে রয়েছেন। বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ২৫ শিশুর বাবা-মায়ের, তালাক ২২ জনের, বিধবা হয়েছে ৪৯ শিশুর মা এবং বিপত্নীক ৬ জন। এসব শিশুর মধ্যে পিতৃহারা ৪৮ জন, মাতৃহারা ৮ জন এবং একজন অনাথ (বাবা-মা কেউ নেই)। এই শিশুদের ৩৯ জন ঝুপড়ি ঘরে, টিনের ঘরে ৪২৭ জন, ইটের দেয়াল ও টিনের ছাউনিতে ২৫৬ জন, আধাপাকা ঘরে ২ জন এবং ভাড়াবাড়িতে ৬ জন শিশু বসবাস করে।
গত তিন দিনে রাজশাহী নগরীর ভদ্রা লেক বস্তি, রেলওয়ে স্টেশন ও রেললাইন এবং এর আশপাশের প্রায় ৩০ জন পথশিশুর সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে পারিবারিক কিংবা আশপাশের কোনো মানুষের মাধ্যমে শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে কেউ সরাসরি কিংবা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে বুঝিয়েছেন।
ভদ্রা বস্তির বিশাল নামের এক পথশিশু বলে, ‘আমার বাবা দুজন। নিজের বাবা মাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মাকে আরেকজন বিয়ে করে; কিন্তু সেও চলে যায়। এখন বস্তিতে আমার মায়ের সঙ্গেই থাকি। আমি বেলুন বিক্রি করি। অনেকেই বেলুন নিতে চায় না। নিতে বললে কেউ মেরে কিংবা কেউ বোকে তাড়িয়ে দেয়। বেলুন বিক্রির যে টাকা আয় হয় পুরোটাই মাকে দিই, সে জমা করে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহিষবাথান এলাকার এক মেয়ে পথশিশু নিজের জীবনের লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। সে বলে, ‘আমার সৎ নানা আমাকে প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতন করত। এমনকি আমার সৎ বাবাও ছাড়েনি। আমি মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত।’
১০ বছর বয়সী মানিক নামে আরেক পথশিশু বলে, ‘বাবা মারা গেছে। মা আরেকটা বিয়ে করেছে। সেই সৎ বাবা ভাংরি কুড়ায় আর মা ভিক্ষা করে। আমি বেলুন বেচি।’ এই বয়সে সেও নানা নির্যাতনের শিকার বলে জানায়।
আজিজুল নামের আরেক পথশিশু জানায়, বাবা-মায়ের স্থায়ী কোনো বাসস্থান না থাকায় নিজের জন্মনিবন্ধন করা যায়নি। সেজন্য কেউ তাকে স্কুলে ভর্তিও করায় না। তার ইচ্ছা বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করার। কিন্তু বস্তির ছেলে হওয়ায় তার ইচ্ছা অধরাই থেকে যাচ্ছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘কারিতাস’-এর ‘আলোকিত শিশু প্রকল্প’ সূত্রে জানা গেছে, কারিতাসের তত্ত্বাবধানে দুটি উন্মুক্ত বিদ্যালয়ে মাত্র ৬০ পথশিশু কেজি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করছে। ২০-২৫ জন শিশু পদ্মা আবাসিক এলাকায় কারিতাসের নিজস্ব আশ্রমে বিনোদন, পড়ালেখা ও তিনবেলা খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
এ ছাড়া আর্থিক সহায়তা পেয়েছে ২৭ জন, কর্মসংস্থান ১৯ জন, কারিগরি প্রশিক্ষণ ৫২ জন, শিক্ষা ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা পেয়েছে ৫৮৮ জন এবং আবাসনের সুযোগ পেয়েছে ২ জন পথশিশু।
রাজশাহী সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাসিনা মমতাজ বলেন, ‘রাজশাহীতে উন্নয়ন সংস্থা ‘কারিতাস’ এবং ‘দুস্থ শিশু পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ রাজশাহী অঞ্চলের পথশিশুদের সুরক্ষায় কাজ করছে। পাশাপাশি সরকারিভাবে এসব শিশুদের জন্য কোনকিছুর প্রয়োজন হলে সেগুলোর ব্যবস্থা সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হয়।’
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজীর আহম্মদ বলেন, ‘এসব পথশিশুদের মায়েদের অপুষ্টি কী, পরিপূরক খাবার ও কোন বয়সে কী পরিমাণ খাবার খেতে হবে সে সম্পর্কে ধারণা নেই। সংগত কারণে পথশিশুদের অধিকাংশই নানা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে এসব শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ প্রয়োজনীয় সুরক্ষার ব্যবস্থা জরুরি।’
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘পথশিশুদের সুরক্ষায় সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। এর মধ্যে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারের একটি বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে, ছোট থেকে বড় কেউই ভবঘুরে হয়ে বাইরে থাকবে না। সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প রয়েছে। সুতরাং বর্তমান সরকার পথশিশুদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষার ব্যবস্থা ভবিষ্যতেও আরও বেশি জোরদার করবে।’