একজন মা, অ্যালিসা ওগলেট্রি, যিনি নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উৎসর্গ করেছেন অসহায় প্রিম্যাচিউর শিশুদের জন্য। বুকের দুধ দান করে তিনি প্রায় সাড়ে ৩ লাখ প্রিম্যাচিউর (এমন একটি অবস্থা যেখানে কোনো শিশুর জন্ম সময়ের আগে অর্থাৎ গর্ভাবস্থার পূর্ণ সময় ৯ মাস হওয়ার আগেই শিশুটি’র জন্ম হয়) শিশুর জীবন বাঁচিয়েছেন, যা মানবিকতা ও মাতৃত্বের এক বিরল উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের তিন সন্তানের মা অ্যালিসার এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা মাতৃত্বের অপ্রকাশিত শক্তিকে প্রমাণ করেছে।
৩৬ বছর বয়সী অ্যালিসা ওগলেট্রির অসামান্য এই অবদান শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয় বরং বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। উত্তর টেক্সাসের ‘মাতৃদুগ্ধ ব্যাংক’ এর তথ্য মতে, অ্যালিসার দান করা দুধের এক একটি ফোঁটা অসংখ্য শিশুর বেঁচে থাকার কারণ হয়ে উঠেছে।
তিনি এ পর্যন্ত ২ হাজার ৬৪৫ লিটার বুকের দুধ দান করেছেন, যা বিশ্বে দানের এক নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। ২০১৪ সালে প্রথমবার তিনি ১ হাজার ৫৬৯ লিটার দুধ দান করে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম লিখিয়েছিলেন, যা এবার নিজেই ভেঙেছেন।
অ্যালিসার এই যাত্রার সূচনা হয় ২০১০ সালে, যখন তার প্রথম সন্তান কাইলের জন্ম হয়। কাইলের জন্মের পর তিনি দেখতে পান যে তার বুকে অস্বাভাবিক পরিমাণে দুধ তৈরি হচ্ছে। তখন একজন নার্সের পরামর্শে তিনি তার এই দুধ অন্য প্রিম্যাচিউর শিশুর জীবন রক্ষার জন্য দান করতে শুরু করেন। এরপর থেকে তিনি ক্রমাগত দুধ দান করে আসছেন। যা প্রতিটি সন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তিনি শুধু মা হননি; হয়ে উঠেছেন হাজারো শিশুর জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
তার সন্তানদের পাশাপাশি ওগলেট্রি সারোগেট মা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কাইলের পর তার আরও দুই সন্তান কেজ (১২) ও কোরি (৭) জন্মগ্রহণ করে এবং প্রতিবারই মা হওয়ার আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে মাতৃদুগ্ধ দান করার প্রতি তার আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায়। ওগলেট্রির সন্তানদের মায়ের দুধ পানের প্রয়োজন না থাকলেও, তার দেহে দুধ উৎপাদন অব্যাহত থাকে। প্রতি ৩ ঘণ্টা পরপর, তিনি ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধরে পাম্প করে দুধ সংগ্রহ করেন। তা ফ্রিজে সংরক্ষণ করেন, যা পরে দান করা হয়।
এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ওগলেট্রি জানান, প্রচুর পানি পান করা, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ এবং সময়সূচি মেনে দুধ পাম্প করাই তার দুধ উৎপাদনের মূল কারণ বলে ধারণা করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমি সবসময়ই প্রচুর পানি পান করেছি এবং নিয়ম মেনে দুধ সংগ্রহ করেছি। প্রতিদিন অনেক কষ্ট করে দুধ সংগ্রহ করি, কারণ আমি জানি যে এর মাধ্যমে অসংখ্য শিশু উপকৃত হবে।’
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমার একটি বড় হৃদয় আছে, কিন্তু প্রচুর অর্থ নেই। অর্থ দান করতে পারি না, তবে দুগ্ধ দানের মাধ্যমে আমি সমাজে অবদান রাখতে পারি।’
এই বিষয়ে অ্যালিসা ওগলেট্র’র নার্স বলেন, এ আত্মত্যাগমূলক জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবতা আসলে হৃদয়ের গভীরে লালিত হয়। যখন কেউ কোনো শিশুর জীবন বাঁচাতে নিজের সমস্ত কিছু উজাড় করে দেন, তখন সেই মানুষটি হয়ে ওঠেন সত্যিকারের মানবতার প্রতীক। অ্যালিসা ওগলেট্রি সেই প্রতীক, যার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার ছোঁয়ায় পৃথিবীর অসংখ্য শিশু আজ জীবনের স্পর্শ পাচ্ছে।
উত্তর টেক্সাসের ‘মাতৃদুগ্ধ ব্যাংক’ এর নির্বাহী পরিচালক শেইনা স্টার্কস অ্যালিসার এই দানে মুগ্ধ হয়ে বলেন, ‘অ্যালিসা শুধু দুধ দিচ্ছেন না, তিনি শিশুরা যাতে বেঁচে থাকতে পারে, তাদের সুস্থতা ও সুখের জন্য অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আমাদের সবার জন্য এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা।’
একটি মায়ের বুকের দুধ যে এত শক্তিশালী হতে পারে, তা অ্যালিসা ওগলেট্রি আমাদের দেখিয়েছেন। তার প্রতিটি ফোঁটা দুধ যেন অসহায় শিশুর জীবন বাঁচানোর আলোকময় এক গল্প। এই গল্প শুধু অ্যালিসার নয়; এটি প্রত্যেক মানুষের, যিনি অন্যের জন্য কিছু করতে চান, কিছু দিতে চান।